
“চলো বন্ধু বদলে যাই, মানবতার বিশ্ব চাই!" এমন স্লোগানে মানুষের ভালোবাসায় বদলে যাচ্ছে সমাজ, তারুণ্যের হাত ধরে জ্বলে উঠছে এক মানবিক আলোর মশাল। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন স্বপ্নবান তরুণ-তরুণীর হাত ধরে শুরু হয় নবোদ্যম ফাউন্ডেশনের যাত্রা। শুরুটা ছিল ক্ষুদ্র, কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল মানবতার বাতিঘর হয়ে ওঠার গভীর অঙ্গীকার। পাঁচ বছরের অদম্য পথচলায় এই উদ্যোগ আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের নানা প্রান্তে, পৌঁছে গেছে প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের গভীরে।
প্রথম আলো জ্বলে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। এরপর একে একে যুক্ত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক শিক্ষাঙ্গন। প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘প্রতিদিন এক টাকা’ কর্মসূচি শুরু হয়, যা ছোট চেষ্টায় বড় স্বপ্ন গড়ার এক অসাধারণ উদাহরণ। এই ক্ষুদ্র অনুদানই ধীরে ধীরে গণমানুষের শক্তি হয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের পথে-ঘাটে আজও লাখো শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যাদের জীবনে বিদ্যালয় এখনো এক দূরবর্তী স্বপ্ন। সেই শিশুদের জন্য নবোদ্যম ফাউন্ডেশনের ‘সেভ দ্য টুমরো স্কুল’ প্রকল্প আশার আলো হয়ে উঠেছে। হাইকোর্ট, মিরপুর, ভৈরব, রাজশাহী থেকে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর আর সাতক্ষীরার তালা—যেখানেই এই স্কুল গড়ে উঠেছে, সেখানেই ফিরেছে ছোট্ট মুখের হাসি। এই স্কুলগুলো শুধু বই-খাতা দেয় না, শেখায় ভালোবাসা আর সম্মান, গড়ে তুলছে সাহসী ভবিষ্যতের বীজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে নবোদ্যম চালু করেছে ‘অ্যাডমিশন হেল্প ডেস্ক’ কর্মসূচি। ভর্তি পরীক্ষার দিন ক্লান্ত দেহে বিনামূল্যে স্যালাইন, পানি আর কাউন্সেলিং যেন হয়ে উঠছে একফোঁটা স্বস্তির বাতাস। ব্যাগ ও মোবাইল রাখার ব্যবস্থাও রাখা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে পরীক্ষা দিতে পারে। গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি ক্লাসের আয়োজন করা হয়, যেন অর্থের অভাবে কোনো স্বপ্ন থেমে না যায়।
পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নবোদ্যমের স্বেচ্ছাসেবকেরা। বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে তারা কিশোর-তরুণদের যুক্ত করছে এক সবুজ বাংলাদেশের স্বপ্নে। তাদের লক্ষ্য শুধু সমাজ নয়, প্রকৃতির সঙ্গেও মানুষকে মেলানো।
দুর্যোগের সময়ে মানুষকে সাহায্য করতে গিয়েও পিছপা হয়নি নবোদ্যম। করোনাকালে ১০ হাজারের বেশি মাস্ক বিতরণ, ৬০০ পরিবারে খাদ্য সহায়তা, আম্ফান ও বন্যায় অসহায় মানুষের জন্য ঘর তৈরি ও নৌকা উপহার দেওয়া—সবই করেছে একান্ত মানবিকতার টানে।
‘নবোদ্যম ব্লাড ফাইটার্স’ দেশের আটটি বিভাগে রক্তের জন্য তৈরি করেছে এক সুদৃঢ় নেটওয়ার্ক। নিজস্ব অ্যাপ, ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্প এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচেষ্টায় প্রতিদিন বেঁচে যাচ্ছে অনেক জীবন। একজন স্বেচ্ছাসেবক, একটি জীবন—এই বিশ্বাসেই এগিয়ে যাচ্ছে পথচলা।
শিল্পের ভাষায়ও ছড়িয়েছে মানবতার বার্তা। করোনাকালে আয়োজিত ‘অন্যরকম ছবি প্রদর্শনী’ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের বন্যার জন্য আয়োজন করা প্রদর্শনী পর্যন্ত—প্রতিটি উদ্যোগই ছিল মানবিক সহায়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রদর্শনীর বিক্রির অর্থ ব্যয় হয়েছে অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে।
‘সত্য মানুষ’ নামের এক অনলাইন অনুষ্ঠানে সম্মান জানানো হয় সেই সব নীরব কর্মীদের, যারা আলো ছড়ান কিন্তু নিজে কোনো আলো চান না। তাদের গল্প সমাজের সামনে তুলে ধরে নবোদ্যম এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইলসহ ২০টির বেশি ইউনিটে পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। তারা শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতাই নয়, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নবোদ্যম ফাউন্ডেশনের স্বপ্ন আরও বড়। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। নজরুলের সেই চিরন্তন উচ্চারণ যেন আজও প্রতিধ্বনিত হয়, “আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?” নবোদ্যম ফাউন্ডেশন ঠিক সেই প্রত্যাশিত সকালের বার্তা হয়ে উঠছে, যেখানে তারুণ্যের শক্তিতে গড়ে উঠছে এক মানবিক পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি।
মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ১৪ জুলাই ২০২৫
যুক্ত থাকুন দ্যা ঢাকা নিউজের সাথে