
স্থানীয় রাজনীতির নামে, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাজি জমি, বাড়ি, মাঠ- ঘাট দখল বারবার সংঘর্ষের নামে অপরাজনীতি ভয়ের সংস্কৃতি আর জনবিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় রাজনীতি এখন আর কেবল জনসেবা বা নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখানে রাজনীতি মানে মাটি, ভোট এবং কখনও কখনও বন্দুক দিয়ে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা।
জমির মালিকানা বনাম প্রভাবশালী রাজনীতি গত এক বছরে হাতে-কলমে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী বা দরিদ্র পরিবারের আইনসম্মত জমি জোরপূর্বক দখল, আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নির্মাণকাজ, প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা ও হুমকি দিন দিন বেড়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম জড়িয়ে থাকা অনেক ঘটনার তদন্ত এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
ভোট মানে নিরাপত্তা নয়, সংশয়
হাতিয়ার বহু গ্রামে মানুষ আজ বলে —
বিএনপি, এনসিপিসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতাদের দলীয় দাপট, কেন্দ্রীয় যোগাযোগ ও পুলিশ প্রশাসনের নীরবতা — সব মিলিয়ে জনগণের ভরসা তলানিতে ঠেকেছে।
জনগণ কী চায়?
তথ্য বলছে পুরো নোয়াখালী সহ হাতিয়ায় উপজেলার শুরু থেকে শেষ সীমানা পর্যন্ত শত শত সাধারণ জনগণের দলীয় প্রভাব বিস্তার করে জমি, মাঠ ঘাট এলাকা প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের দখলে গেছে, সেখানে তরুণ প্রজন্ম এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। তারা বলছে: “নেতা মানে উন্নয়ন, এখন তা যেন সবকিছু দখল করার চুক্তি।”
তথ্য বলছে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর শুধু মাত্র নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা সাধারণ জনগণের জমি, মাঠ ঘাট জোরপূর্বক, জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা সহ বহু ঘটনা ঘটেছে এসব তথ্য নিয়ে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। হাতিয়ার নিম্ন সাধারণ জনগণের মতামত আমরা বাঁচতে চাই। হাতিয়াতে কি কখনোই অপরাজনীতির পরিবর্তন হবে না?
জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাতিয়া আসন (নোয়াখালী -৬) থেকে ২১ জনের একটা তালিকা এসেছে এবং সবার মুখে মুখে, প্রচার প্রচারণার বিত্তি করে মিছিল সভা মিটিং এর মাধ্যমে জানা গেছে এমপি পদপ্রার্থী হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মনোনয়ন চাইবেন,
উল্লেখ যোগ্য কয়েকজনের মধ্যে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, হাতিয়া উপজেলার সাবেক বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তানভীর উদ্দিন রাজিব, এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দলের উজ্জ্বল নক্ষত্র শাহনেওয়াজ।
এছাড়াও জুলাই আন্দোলনের বিপ্লবী সাহসী যোদ্ধা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ । বাংলাদেন জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট শাহ মাহফুজুল হক মূলত হাতিয়ার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ৫ জনই রয়েছেন সাধারণ জনগণসহ চায়ের দোকানের আলোচনায়।
নিম্ন বিত্ত সাধারণ মানুষের দাবী হাতিয়ার অপরাজনীতি চিরতরে বন্ধ হোক, রাজনীতি হোক সাধারণ মানুষের কল্যাণে। সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা হাতিয়ার উন্নয়নে কাজ করুক সাধারণ মানুষই খুঁজে নিবে কাকে তাদের নেতা বানাবে।
আবদুল মান্নান (৬৫) কৃষক, বুড়িরচর ইউনিয়ন বলেন, আমার দাদার নামে যে জমি, সেটার খাজনা আমি দিছি। তাও একটা লোক রাজনৈতিক নেতা দাবী কারে ওখানে ঘর তুলতেছে সরকার পতনের পর। সরকার কইছে জমি রক্ষা করব, এখন দেখি জমির রক্ষা করতে নেতা হওয়া লাগে।
মোঃ শহিদ উল্যা (৫৮) জেলে, সুখচর ইউনিয়ন, হাতিয়া বলেন, “সাগরে মাছ ধরতে গেলে ঝড়-বৃষ্টি বুঝি, কিন্তু মাটির উপরও যে এখন ভয় আছে, সেটা আগের জানতাম না। আমাদের ঘাটের পাশে ঘর ছিল, দলবদলের পর সেই ঘর আর নাই। আমি তো জেলেমানুষ ভাই, রাজনীতি বুঝি না — কিন্তু যখন ঘর উজাড় হয়, তখন রাজনীতি আমার ঘরেরও চাবি রাখে। এখন মনে হয়, শুধু সাগরে না, মাটিতেও জাল ফেলা শুরু করছে রাজনীতি।”
নাজমা খাতুন (৩৮) প্রবাসীর স্ত্রী, সোনাদিয়া বলেন, “আমার স্বামী মালয়েশিয়ায় থাকে, জমি তার নামে। বিএনপি নেতা দাবী করে লোক আইসা কয়, দল করো আর হাজার টাকা চাঁদা দাও তাহলে জমি থাকবে। আমি রাজনীতি বুঝি না ভাই, শুধু চাই ঘরটা যেন আমার থাকে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়া পৌরসভার এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “ভুল হতেই পারে, কিন্তু সব রাজনীতিক দোষী না। অনেক সময় কর্মী ভুল করে, তার দায় দল নেয়। আমরাও না জেনে বহু দোষ করেছি, তখন বুঝতে পারিনি এখন ক্ষমতা যাওয়ার পরে আমরা বুঝি। ক্ষমতা না গেলে বুঝতাম না। তখন ভালো কাজ করলে ক্ষমতা গেলেও জনগণ মাথায় তুলে রাখতো। তবে সাংবাদিকদের উচিত গুছিয়ে লেখা – যেন মানুষ বিভ্রান্ত না হয়।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়ার সনামধন্য বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন,
“রাজনীতি যদি ভয় তৈরি করে, ভোট সেখানে শুধু সংখ্যা হয়ে পড়ে। মানুষের অধিকার নেই।”
পরিবর্তনের সম্ভাবনা কি আছে? মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শিখেছে। একজন বীর সাংবাদিক আহত হলেও থেমে না থেকে প্রতিবেদন চালিয়ে গেছেন — এটা জানান দেয়, পরিবর্তনের শুরুটা ভয়কে অস্বীকার করা থেকে। যদি সত্যকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়, যদি রাজনীতি হয় উন্নয়নের হাতিয়ার, তাহলে হাতিয়া একদিন বদলাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, উপজেলা নির্বাহী অফিসের এক কর্মচারী বলেন “কিছু নেতারা আছে, যারা মামলা ঠেকাতে লোক ভাড়া করে। কেউ প্রতিবেদন করলে সাংবাদিককে ভয় দেখায়। আমি প্রশাসনের লোক, তবু অনেক সময় কিছু করতে পারি না – কারণ পেছনে একটা ফোনেই সব থেমে যায়।”
একজন রাজনীতি বিশ্লেষকের সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি বলেন, “হাতিয়ার রাজনীতি এখন এক রকম স্থায়ী ত্রাস সংস্কৃতি-তে পরিণত হয়েছে। মাটি, ভোট ও ভয় – এই তিনের বৃত্ত থেকে বের হতে হলে স্থানীয় সচেতনতা, মিডিয়া কাভারেজ ও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার।”
নোয়াখালী (৬) হাতিয়া বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, হাতিয়ার রাজনীতি যদি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবে জনগণ একদিন জবাব দেবে। আর যদি রাজনীতি জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়, তবে হাতিয়াও একদিন "ভয়ের রাজনীতি" থেকে বেরিয়ে আসবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেন বলেন, আমাদের কাজ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী হবে। কোন রাজনৈতিক পরিচয়ে বে আইনি কাজ করা যাবে না। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জমি দখল সংক্রান্ত অভিযোগ পাচ্ছি এবং অভিযোগ গুলো নিষ্পত্তি চেষ্টা করছি। আমরা চাই জনগণ সরাসরি অভিযোগ করুক, কিন্তু তারা ভয় পাই। সাংবাদিকদের প্রতিবেদন আমাদের কাজে সহায়ক হয় - তবে প্রতিবেদন যেন তথ্যনির্ভর ও নির্ভীক হয়।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), আলাউদ্দিন বলেন, “হাতিয়া একটি সংবেদনশীল এলাকা — এখানে মাটি, ভূমি, দলীয় রাজনীতি ও জনস্বার্থ একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িত। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমি সংক্রান্ত সব অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখি। তবে যারা ভোগান্তির শিকার তাদেরকে অনুরোধ করব তারা যেন সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করে প্রতিকার পাওয়ার আবেদন করে। আমরা সবসময় চেষ্টা করি, স্থানীয় জনগণের ভয় দূর করতে কারণ উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন ভয়হীন পরিবেশে প্রশাসন ও জনগণ একসাথে কাজ করতে পারে। তাছাড়াও সাংবাদিকদের তথ্যনির্ভর, সঠিক ও সাহসী প্রতিবেদন প্রশাসনকে স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়তা করে।
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ২২ জুন ২০২৫
যুক্ত থাকুন দ্যা ঢাকা নিউজের সাথে