শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
The Dhaka News Bangla

হার্বেরিয়াম: নির্জীব বাগান, তবু জীবনের ছাপ

হার্বেরিয়াম: নির্জীব বাগান, তবু জীবনের ছাপ
ছবি: সংগৃহীত

একটা পাতার জীবন যখন গাছে থাকে, তখন সে বাতাসে দুলে উঠে, সূর্যের আলো গায়ে মেখে বেঁচে থাকে। কিন্তু সেই পাতা যদি একদিন শুকিয়ে যায়, কেটে ফেলে দেওয়া হয়, তখন কি তার আর কোনো মূল্য থাকে? উদ্ভিদবিদ্যার জগতে হার্বেরিয়াম সেই শুকিয়ে যাওয়া পাতাকে আবার জীবনের পাঠশালায় ফিরিয়ে আনে, জীবিত নয়, তবু অর্থবহভাবে। হার্বেরিয়াম একদিকে যেমন নির্জীব এক বাগান, তেমনি অন্যদিকে সময়ের গায়ে লেখা এক প্রাণবন্ত দলিল।

হার্বেরিয়াম (Herbarium) মূলত একটি সংগ্রহশালা, যেখানে গাছপালা- পাতা, ফুল, ফল, বীজ, এমনকি সম্পূর্ণ উদ্ভিদের শুকনো নমুনা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো নির্দিষ্ট কাগজে চেপে, ডাটা লেবেলসহ সংগ্রহ করে রাখা হয় ভবিষ্যৎ গবেষণা, পরিচিতি, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষার উদ্দেশ্যে।

নমুনাগুলো শুধু শুকনো পাতা বা ফুল নয়; প্রতিটিই একটি সময়ের, একটি স্থানের, এমনকি একটি পরিবেশের প্রতিনিধি। ফলে, হার্বেরিয়াম হয়ে ওঠে উদ্ভিদের ইতিহাসের গ্রন্থাগার।

হার্বেরিয়ামের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ১৬শ শতকে ইতালির চিকিৎসক লুকা ঘিনি প্রথমবারের মতো হার্বেরিয়াম তৈরির ধারণা দেন। সময়ের পরিক্রমায় তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ ও আমেরিকায়। বর্তমানে বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে রয়েছে হাজার হাজার উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষিত। অনেক জায়গায় এসব হার্বেরিয়াম ২০০ বছরের পুরনোও।

বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত সব হার্বেরিয়াম যেমন রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ (ইংল্যান্ড), হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্রে হার্বেরিয়াম বা ভারতের বিআইএস-এর ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম তেমনি বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগগুলোতেও গড়ে উঠেছে একেকটি গবেষণার নির্জন ভাণ্ডার।

বাংলাদেশেও রয়েছে কিছু উল্লেখযোগ্য হার্বেরিয়াম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবথেকে বড় বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম, মিরপুরে অবস্থিত। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি নমুনা রয়েছে সেখানে, যার মধ্যে অনেক প্রজাতিই আজ আর প্রকৃতিতে দেখা যায় না। এসব হার্বেরিয়ামগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে দেশের উদ্ভিদসম্পদ সংরক্ষণে। গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল হার্বেরিয়ামও বৈশ্বিকভাবে সহজলভ্য করছে।

প্রতিটি নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে দেওয়া হয় সুনির্দিষ্ট তথ্য: গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম, সংগ্রহস্থল, তারিখ, সংগ্রাহকের নাম, গাছটির উচ্চতা, বৈশিষ্ট্য, এমনকি কখন কখন ফুল ও ফল ধরে। এই তথ্যগুলো গবেষকের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে একেকটি প্রমাণপত্র।

হার্বেরিয়ামগুলো দেখতে অনেকটা লাইব্রেরির মতো কেবল বইয়ের বদলে কাচঘেরা ক্যাবিনেটে পাতার দলিল। প্রতিটি পাতায় লেখা আছে একটি গল্প যে গল্পে হয়তো রয়েছে একটি বিলুপ্তপ্রায় গুল্মের শেষ নিদর্শন, হয়তো রয়েছে একটি বিরল গাছের প্রথম নমুনা, হয়তোবা একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান।

এই নির্জীব পাতাগুলোই জীবনের এমন ভাষা নিয়ে কথা বলে, যা কেবল একটি মনোযোগী ছাত্র বা গবেষকই বুঝতে পারে।

তবে শুধু গবেষণাই নয়, হার্বেরিয়াম শিক্ষার্থীদের কাছে হাতে-কলমে শেখার জায়গাও। একেকটা নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে যেমন মাঠে যেতে হয়, তেমনি কৌশলে চেপে রাখতে হয় গাছের প্রকৃত গঠন। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ।

তরুণদের কেউ কেউ হার্বেরিয়ামকে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করছে। শুকনো পাতার বুকমার্ক, হ্যান্ডমেইড কার্ড বা ওয়াল আর্ট এসবেও হার্বেরিয়ামের ছোঁয়া লাগছে। 

বিশ্বজুড়ে যখন গাছ কাটা, বন উজাড় আর জৈব বৈচিত্র্যের হুমকি প্রকট হয়ে উঠছে, তখন হার্বেরিয়াম আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ফুল আসলে একেকটি জীবন, যাকে সংরক্ষণ না করলে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকেও। নতুন প্রজন্মের উচিত উদ্ভিদকে জানা, তাদের সংরক্ষণে এগিয়ে আসা এবং গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গড়ে তোলা।

হারিয়ে যাওয়া কোনো ফুলের খোঁজে, হয়তো একদিন বিজ্ঞানী কোনো পুরোনো হার্বেরিয়ামের পাতায় ফিরে যাবে। তার চোখে ধরা পড়বে এক যুগ আগের কোনো ফুলের ছাপ, যেটি আজ আর কোথাও নেই। তখন সেই শুকনো পাতাই হয়ে উঠবে পৃথিবীর একমাত্র প্রমাণ।

এইভাবে একফালি পাতায়, একটুখানি যত্নে বাঁচিয়ে রাখা যায় প্রকৃতির গল্প। হার্বেরিয়াম যেন এক জীবন্ত সংগ্রহ, যেখানে গাছেরা নীরবে বলে চলে তাদের কথামালা।


বিষয় : হার্বেরিয়াম উদ্ভিদবিজ্ঞান

যুক্ত থাকুন দ্যা ঢাকা নিউজের সাথে

The Dhaka News Bangla

শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫


হার্বেরিয়াম: নির্জীব বাগান, তবু জীবনের ছাপ

প্রকাশের তারিখ : ১০ মে ২০২৫

featured Image
একটা পাতার জীবন যখন গাছে থাকে, তখন সে বাতাসে দুলে উঠে, সূর্যের আলো গায়ে মেখে বেঁচে থাকে। কিন্তু সেই পাতা যদি একদিন শুকিয়ে যায়, কেটে ফেলে দেওয়া হয়, তখন কি তার আর কোনো মূল্য থাকে? উদ্ভিদবিদ্যার জগতে হার্বেরিয়াম সেই শুকিয়ে যাওয়া পাতাকে আবার জীবনের পাঠশালায় ফিরিয়ে আনে, জীবিত নয়, তবু অর্থবহভাবে। হার্বেরিয়াম একদিকে যেমন নির্জীব এক বাগান, তেমনি অন্যদিকে সময়ের গায়ে লেখা এক প্রাণবন্ত দলিল।হার্বেরিয়াম (Herbarium) মূলত একটি সংগ্রহশালা, যেখানে গাছপালা- পাতা, ফুল, ফল, বীজ, এমনকি সম্পূর্ণ উদ্ভিদের শুকনো নমুনা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো নির্দিষ্ট কাগজে চেপে, ডাটা লেবেলসহ সংগ্রহ করে রাখা হয় ভবিষ্যৎ গবেষণা, পরিচিতি, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষার উদ্দেশ্যে।নমুনাগুলো শুধু শুকনো পাতা বা ফুল নয়; প্রতিটিই একটি সময়ের, একটি স্থানের, এমনকি একটি পরিবেশের প্রতিনিধি। ফলে, হার্বেরিয়াম হয়ে ওঠে উদ্ভিদের ইতিহাসের গ্রন্থাগার।হার্বেরিয়ামের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ১৬শ শতকে ইতালির চিকিৎসক লুকা ঘিনি প্রথমবারের মতো হার্বেরিয়াম তৈরির ধারণা দেন। সময়ের পরিক্রমায় তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ ও আমেরিকায়। বর্তমানে বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে রয়েছে হাজার হাজার উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষিত। অনেক জায়গায় এসব হার্বেরিয়াম ২০০ বছরের পুরনোও।বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত সব হার্বেরিয়াম যেমন রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ (ইংল্যান্ড), হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্রে হার্বেরিয়াম বা ভারতের বিআইএস-এর ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম তেমনি বাংলাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগগুলোতেও গড়ে উঠেছে একেকটি গবেষণার নির্জন ভাণ্ডার।বাংলাদেশেও রয়েছে কিছু উল্লেখযোগ্য হার্বেরিয়াম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবথেকে বড় বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম, মিরপুরে অবস্থিত। প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি নমুনা রয়েছে সেখানে, যার মধ্যে অনেক প্রজাতিই আজ আর প্রকৃতিতে দেখা যায় না। এসব হার্বেরিয়ামগুলো প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে দেশের উদ্ভিদসম্পদ সংরক্ষণে। গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল হার্বেরিয়ামও বৈশ্বিকভাবে সহজলভ্য করছে।প্রতিটি নমুনা সংগ্রহের সঙ্গে দেওয়া হয় সুনির্দিষ্ট তথ্য: গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম, সংগ্রহস্থল, তারিখ, সংগ্রাহকের নাম, গাছটির উচ্চতা, বৈশিষ্ট্য, এমনকি কখন কখন ফুল ও ফল ধরে। এই তথ্যগুলো গবেষকের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে একেকটি প্রমাণপত্র।হার্বেরিয়ামগুলো দেখতে অনেকটা লাইব্রেরির মতো কেবল বইয়ের বদলে কাচঘেরা ক্যাবিনেটে পাতার দলিল। প্রতিটি পাতায় লেখা আছে একটি গল্প যে গল্পে হয়তো রয়েছে একটি বিলুপ্তপ্রায় গুল্মের শেষ নিদর্শন, হয়তো রয়েছে একটি বিরল গাছের প্রথম নমুনা, হয়তোবা একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান।এই নির্জীব পাতাগুলোই জীবনের এমন ভাষা নিয়ে কথা বলে, যা কেবল একটি মনোযোগী ছাত্র বা গবেষকই বুঝতে পারে।তবে শুধু গবেষণাই নয়, হার্বেরিয়াম শিক্ষার্থীদের কাছে হাতে-কলমে শেখার জায়গাও। একেকটা নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে যেমন মাঠে যেতে হয়, তেমনি কৌশলে চেপে রাখতে হয় গাছের প্রকৃত গঠন। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ।তরুণদের কেউ কেউ হার্বেরিয়ামকে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করছে। শুকনো পাতার বুকমার্ক, হ্যান্ডমেইড কার্ড বা ওয়াল আর্ট এসবেও হার্বেরিয়ামের ছোঁয়া লাগছে। বিশ্বজুড়ে যখন গাছ কাটা, বন উজাড় আর জৈব বৈচিত্র্যের হুমকি প্রকট হয়ে উঠছে, তখন হার্বেরিয়াম আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ফুল আসলে একেকটি জীবন, যাকে সংরক্ষণ না করলে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকেও। নতুন প্রজন্মের উচিত উদ্ভিদকে জানা, তাদের সংরক্ষণে এগিয়ে আসা এবং গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গড়ে তোলা।হারিয়ে যাওয়া কোনো ফুলের খোঁজে, হয়তো একদিন বিজ্ঞানী কোনো পুরোনো হার্বেরিয়ামের পাতায় ফিরে যাবে। তার চোখে ধরা পড়বে এক যুগ আগের কোনো ফুলের ছাপ, যেটি আজ আর কোথাও নেই। তখন সেই শুকনো পাতাই হয়ে উঠবে পৃথিবীর একমাত্র প্রমাণ।এইভাবে একফালি পাতায়, একটুখানি যত্নে বাঁচিয়ে রাখা যায় প্রকৃতির গল্প। হার্বেরিয়াম যেন এক জীবন্ত সংগ্রহ, যেখানে গাছেরা নীরবে বলে চলে তাদের কথামালা।

The Dhaka News Bangla

প্রকাশক এবং সম্পাদক : তাসকিন আহমেদ রিয়াদ 

কপিরাইট © ২০২৫ The Dhaka News Bangla । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত