
সাইমা হাসান: বাংলা সাহিত্যের বিস্ময় ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ যেন নতুন রূপ পেল
চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
লোকসাহিত্যভিত্তিক পাঠ্যাংশকে যখন মঞ্চে নিয়ে আসা হয়; তখন তা শিক্ষার্থীদের কাছে
হয়ে ওঠে একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। তখন তা গেঁথে থাকে
শিক্ষার্থীদের মনে ও মস্তিষ্কে।
বাংলা অনার্স ৩য় বর্ষে ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’র ‘মহুয়া’ পালাটি ‘ফোকলোর
তত্ত্ব ও বাংলা লোকসাহিত্য’ বিষয়ক কোর্সের পাঠ্য। চট্টগ্রাম কলেজের সহকারী অধ্যাপক
মোহাম্মদ নুরুজ্জামান প্রায়ই ক্লাসের অবসরে কিংবা সাংস্কৃতিক আড্ডায় কলেজের
বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সেই কাহিনি একরকম দুষ্টুমি করে শোনাতে শোনাতে শেষ
পর্যন্ত কলেজ মঞ্চে ক্ষুদ্র পরিসরে ‘মহুয়া-বিরহ’ নামে একটি অংশ পরিবেশন করলেন।
পুরো এপ্রিলজুড়ে চলে আয়োজনের প্রস্তুতি। আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়
শিক্ষার্থীদের হাতেই। আমন্ত্রণপত্র ছাপানো ও তার খামের ওপর নকশা করা থেকে শুরু করে
অতিথি আমন্ত্রণ ও পরিবেশনার রিহার্সাল—সব কিছুতেই ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। অবশেষে গত ২৯ এপ্রিল সকাল
১০টায় কলেজ অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা: বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়’
শীর্ষক সেমিনার ও লোকগানের আসর।
বাংলা বিভাগের এ আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক
মোহাম্মদ মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুব্রত
বিকাশ বড়ুয়া। এ ছাড়া অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান
অধ্যাপক শামীমা বেগম। এ ভিন্নমাত্রিক আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলা বিভাগসহ
কলেজের অন্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
দর্শকদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠানকে দুটি অংশে
বিভক্ত করা হয়েছে—সেমিনার ও
লোকগানের আসর। জ্ঞান ও বিনোদন—দুটোই দারুণ
বিকল্প বন্দোবস্ত ছিল। কোরআন তেলাওয়াত, গীতা পাঠ ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে শুরু হয়
অনুষ্ঠান। এরপর লালনের ‘জাত গেল জাত গেল বলে’ গানটি পরিবেশিত হয় চতুর্থ বর্ষের এক
ছাত্রের কণ্ঠে।
গান শেষে সেমিনার পর্বের শুরুতে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
মোহাম্মদ নুরুজ্জামান তার লেখা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। যেখানে উঠে আসে
মৈমনসিংহ-গীতিকার ইতিহাস, স্বাতন্ত্র্য পর্যালোচনা, লোকসাহিত্যক গুণাবলি, ধর্ম ও
জীবনভাবনা, নারীচরিত্রের ঔজ্জ্বল্য, কাব্যমূল্য ও প্রেমের প্রতিচ্ছবি এবং লোকগীতির
ভাষার সজীবতা।
এ ছাড়া প্রবন্ধ আলোচনায় অংশ নেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল
আলম চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুস সালাম এবং বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক
শামীমা বেগম।
এরপর শুরু হয় লোকগানের আসর। এ লোকগানের আসরে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ
করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের গ্রামীণ ও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ‘হঁলা গান’।
পরিবেশনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক মুহিব কাদেরী। তাদের
প্রাণবন্ত নেতৃত্বে ‘হঁলা গান’ পরিবেশন যেন শ্রোতাদের এক অনন্য লোকজ আবেশে ভাসিয়ে
নেয়।
এরপর সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল সালাম পরিবেশন করেন
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জনপ্রিয় গান ‘বাঁশখালী মইশখালী’। সব শেষে পরিবেশিত হয় অনুষ্ঠানের
প্রধান আকর্ষণ ‘মহুয়া’ পালা। যদিও সময়ের অভাবে পুরো পালাটি মঞ্চায়িত করা সম্ভব
হয়নি। তবুও এর অংশবিশেষ ‘মহুয়া-বিরহ’ উপস্থিত সবার হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। সবার
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জ্ঞান ও গানের সম্মিলিত মেলবন্ধনে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য
দিয়ে আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।
এ আয়োজন প্রমাণ করে, বাংলা সাহিত্যের মর্ম বুঝতে শুধু বইয়ের পাতা
নয়, প্রয়োজন বাস্তব স্পর্শ, সৃজনশীল চর্চা আর ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করার মানসিকতা।
চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাহিত্য শিক্ষায়
এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বিষয় : লোকগান চট্টগ্রাম কলেজ
শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ০৭ মে ২০২৫
যুক্ত থাকুন দ্যা ঢাকা নিউজের সাথে