তানজিদ শুভ্র, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ||
যে সমাজে শিক্ষক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত, সে সমাজ জ্ঞান ও মানবিকতার দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান নয়, বরং প্রজন্মকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার দিকনির্দেশনা। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের ভাবনা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তানজিদ শুভ্র।শিক্ষক মানেই মূল্যবোধের আলোযথার্থ শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা- যা মনের প্রসার ঘটায়। যে শিক্ষা আকাশের বিশালতাকে ধারণ করতে শেখায়, যে শিক্ষা মহাসমুদ্রের কল্লোলকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দেয়- সে শিক্ষা দানকারী ব্যক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষক সম্পর্কে বলতে গেলে এক কথায় বলতে হয়- “আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”।একজন শিক্ষক নিজে সমস্যা জর্জরিত থেকেও আলোর ঝরনা বয়ে বেড়ান। জাতির মানসিক বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে শিক্ষক প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারেন।শিক্ষকতা এক মহান ব্রত। এই ব্রতই পারে হৃদয়ের আশাকে জাগ্রত করতে। আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈব বাণীকে সত্যরূপ দিতে। একজন শিক্ষকের মুখনিঃসৃত বাণী শিক্ষার্থীদের মন, মনন ও চিন্তাকে বদলে এক সফল উপাখ্যানে রূপ দিতে পারে।শিক্ষার আসল কাজ মূল্যবোধ সৃষ্টি, জ্ঞান দান নয়; জ্ঞান মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় মাত্র। জ্ঞান ও অন্তরের মুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিকে মনুষ্যত্ববোধ উন্নীত হওয়ার শিক্ষা দেন একজন শিক্ষক। তাই তো শিক্ষক পূজনীয়। শিক্ষক দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মন্ত্রে পথ চলায় ভয়হীন ও দৃঢ় হবেন। একটি শ্রেণিহীন সমাজ বিনির্মাণে আলোর মিছিলে যোগ দিতে শিক্ষক হতে পারেন প্রেরণার উৎস।৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকবৃন্দের জন্য রইল হৃদয় নিংড়ানো প্রনতি। আখতার জাহান শাম্মীসহযোগী অধ্যাপক (উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ)ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলজে, গাজীপুর। বাংলাদেশে শিক্ষকতার বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্যশিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। শিক্ষা একটি জাতির সংস্কৃতি ও সম্ভাবনাকে জাগ্রত রাখে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবস্থানকে সুসংহত করে।প্রতিবছর শিক্ষক দিবস আসে, নতুন প্রতিপাদ্য থাকে, আমরা তা পালনও করি। কিন্তু এই দিবস পালন কতটুকু লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে সেটা একটা প্রশ্ন। সমন্বয়হীনতা বা সমস্যা ঠিক কোন জায়গায় যা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না, ভাববার সময় বয়ে যাচ্ছে আমাদের লক্ষ্য হওয়া দরকার কেবল পাশের হার বাড়িয়ে শিক্ষার প্রসার নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কমানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ, শিক্ষকের জন্য সময়মতো পদোন্নতি ও সম্মানজনক জীবিকার সংস্থানের মতো বিষয়, সবগুলোই।মানসম্মত শিক্ষার প্রসার এর জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত একটি প্রধানতম বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কম হলে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দক্ষতা অনুসারে শিক্ষকরা আলাদা শিক্ষণ কৌশল তৈরি করতে পারেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২০ কে আদর্শিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এই অনুপাত ১:৩৪ (স্কুল) থেকে ১:৫৮ (বিশ্ববিদ্যালয়) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১:২০০ পর্যন্ত দেখা যায় (বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২১)। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ এই অনুপাত ১:৩০ করার প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের উচিত এই অনুপাত ১:২০ করার লক্ষ্য ঠিক করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা।অবকাঠামো উন্নয়ন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্কুল,কলেজ,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত ব্যপক সমস্যা রয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবহারিক ল্যাবরেটরি সুবিধা। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরো করুণ।দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষকের প্রচুর পদ শূন্য রয়েছে। এগুলোতে দ্রুততম সময়ে নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবিকার অধিকারকে আমরা যদি অস্বীকার করি তাহলে সব আয়োজন সত্ত্বেও সকল সম্ভাবনা ভেস্তে যেতে বাধ্য। সময়মতো পদোন্নতি না পেলে একজন শিক্ষক হতাশায় ভুগেন এবং শ্রেণিকক্ষে তিনি আকর্ষণীয় উপস্থাপনে উৎসাহ হারাবেন এটাই স্বাভাবিক। সম্মানজনক জীবিকার অধিকার এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সকলের মতো একজন শিক্ষকেরও রয়েছে, তিনি সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত নাকি এমপিওভুক্ত তা দেখার বিষয় না। একজন শিক্ষককে যদি তার পদোন্নতি ও জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামতে হয় তাহলে তার কাছ থেকে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা যায় না। সুফল পেতে নীতিনির্ধারকদের সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। হামিদা আনজুমানসহযোগী অধ্যাপক (রসায়ন বিভাগ)নরসিংদী সরকারি কলেজ, নরসিংদী। শিক্ষকের কাছে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকাশিক্ষক হিসেবে আজকের এই বিশেষ দিনে নতুন করে উপলব্ধি করি আমার দায়িত্ব ও অঙ্গীকারকে। শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি হলো মানুষের ভেতরের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা, মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং সমাজের জন্য একজন সৎ, নৈতিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি করা। প্রতিটি শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছে কেবল একজন ছাত্র নয়, বরং ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। তাদের মনোজগতে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া এ মহান পেশার সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কখনো কখনো কঠোর হতে হয়, আবার কখনো বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতে হয়। কারণ, প্রকৃত শিক্ষা মানে হলো শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা এবং সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ। আমি বিশ্বাস করি, একজন শিক্ষকের প্রকৃত অবদান কখনো ক্ষয় হয় না। ছাত্র যখন জীবনের নানা ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করবে, সমাজকে এগিয়ে নেবে—সেই মুহূর্তেই একজন শিক্ষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। তাই এই শিক্ষক দিবসে নিজেকে স্মরণ করাই, শিক্ষা হলো আজীবন দান করার এক মহৎ যাত্রা, যেখানে প্রতিটি ছোট সাফল্যই একজন শিক্ষকের বড় আনন্দ। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছেন, “ভালো শিক্ষক কখনো কেবল পড়ান না, তিনি জীবনের স্বাদ শেখান।” এই উক্তি আমার কাছে সবচেয়ে বড় দিশা। আমি চাই, শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করুক তা-ই নয়, বরং তারা সত্যিকারের মানুষ হোক—সৎ, নৈতিক, সাহসী ও আলোকিত মানুষের গুণাবলি নিয়ে। তুহিনুর রহমানসহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর। শিক্ষক সমাজের আসল আলোকবর্তিকাশিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তকের মুখস্থ জ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রজন্মকে নৈতিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধে আলোকিত করার এক অবিরাম প্রক্রিয়া। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি এক জীবন্ত প্রাণমাত্র, কিন্তু সামাজিকীকরণের ধারায়, পরিবার ও বিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। এই ব্যক্তিত্ব বিকাশের যাত্রাপথের কেন্দ্রে রয়েছেন শিক্ষক—যিনি জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের প্রধান কারিগর।শিক্ষকের জীবনদর্শন, নৈতিকতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা যেমন শিক্ষার্থীদের বিকাশে অপরিহার্য, তেমনি তাঁর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষক যে সম্মান ও মর্যাদা সমাজে লাভ করেন, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধের বীজ রোপণ করে। তাই শিক্ষককে কেবল জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে কথার ফুলঝুড়িতে বন্দনা করলেই হবে না; রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তাঁর উপযুক্ত পদমর্যাদা, আর্থিক সুরক্ষা ও সামাজিক স্বীকৃতিও নিশ্চিত করতে হবে।সহজ করে বলা যায়, আজকের শিক্ষার্থী যেমন আগামী দিনের নেতৃত্ব, তেমনি আজকের শিক্ষকই আগামীর দীক্ষাগুরু। শিক্ষা কেবল জ্ঞানের দীক্ষা নয়, এটি মূল্যবোধ ও মানবিকতার আলোকপ্রদীপ। সেই আলো যেন টিকে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে—এ দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের সকলের। মো. সেলিম হাসান দুর্জয়প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর। শিক্ষক দিবসে আমার ভাবনা, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশাশিক্ষক একজন পথপ্রদর্শক, যিনি শিক্ষার্থীদের অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান। শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, এই পেশা শুধু চাকরি নয়, বরং এটি এক মহৎ দায়িত্ব ও আত্মার তৃপ্তির মাধ্যম।প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করার সময় শিশুদের কৌতূহলী চোখে যে স্বপ্ন দেখি, সেটাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। জ্ঞান দেওয়ার পাশাপাশি একজন শিক্ষক শেখান মানবতা, মূল্যবোধ ও জীবনের বাস্তব পাঠ। তবে আমার দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি একটি সঠিক উৎসাহ, একটি মৃদু হাসি কিংবা একটি প্রশংসার শব্দ যেকোনো শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে। হাসিখুশি মনোভাব ও উৎসাহের মাধ্যমে অনেক কঠিন বিষয়ও তাদেরকে সহজভাবে শেখানো যায়। যেটার প্রমাণ আমি নিজ চোখে দেখছি।আজকের এই দিনে আমার প্রত্যাশা, শিক্ষককে যেন শুধু পাঠদাতা হিসেবে নয়, একজন জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটানো হোক। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে যেন প্রতিটি শিক্ষক গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন যে আমি একজন শিক্ষক, আমি আলোর পথের দিশারি। জাবেদুর রহমানশিক্ষকএবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।