অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ, ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ||
বই মানেই কাগজের পাতা উল্টে পড়া, এই চিরায়ত ধারণাটি এখন দ্রুত বদলে দিচ্ছে প্রযুক্তি। ব্যস্ত জীবনে স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন আর বই পড়ার জন্য আলাদা করে সময় বের করার প্রয়োজন হয় না; কাজের ফাঁকে, শহরের দীর্ঘ যানজটে আটকে থেকে কিংবা বিশ্রামের অবসরেকানে হেডফোন গুঁজে অনায়াসেই প্রবেশ করা যায় গল্প, জ্ঞান আর বিনোদনের এক নতুন জগতে। অডিওবুক হয়ে উঠছে আমাদের নতুন সঙ্গী।বিশ্বজুড়ে বই শোনার বিপ্লববিশ্বব্যাপী অডিওবুক শিল্প এক নীরব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অডিওবুক বাজারের আকার ছিল প্রায় ৬.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ২৬ শতাংশ হারে এই শিল্পের প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এই অভাবনীয় বৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে স্মার্টফোনের ক্রমবর্ধমান প্রসার। এখন যেকোনো সময় ও যেকোনো স্থান থেকে পছন্দের বইটি শোনার সুযোগ থাকায় এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে অডিওবুকের আবেদন সবচেয়ে বেশি। তারা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে সেলফ-হেল্প বা আত্ম-উন্নয়নমূলক বই পর্যন্ত শুনছে। বিশেষত, যেসব মানুষ আগে বই পড়তেন না বা কম পড়তেন, তারাও এখন অডিওবুকের মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে ফিরে আসছেন।সম্ভাবনার বাংলাদেশ ও ‘কাব্যিক’বিশ্বের এই হাওয়া বাংলাদেশেও লাগতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১৩ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। পাশাপাশি, ২০২২ সালে যেখানে দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার ছিল ৪৭ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ সাল নাগাদ তা ৬৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এই তরুণ, প্রযুক্তিবান্ধব এবং অনলাইন-সচেতন প্রজন্মই বাংলা অডিওবুকের মূল শ্রোতা হওয়ার অপার সম্ভাবনা রাখে।এই সম্ভাবনার বাস্তব রূপ দিতেই ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলা অডিওবুক ও পডকাস্টের প্ল্যাটফর্ম ‘কাব্যিক’। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বর্তমানে কাব্যিকের লাইব্রেরিতে রয়েছে তিন হাজারের বেশি অডিওবুক ও পডকাস্ট। হরর, থ্রিলার, রোম্যান্স, ক্লাসিক, মোটিভেশনাল, ধর্মীয় ও শিশুতোষ, সব ধরনের বিভাগই এখানে যত্ন সহকারে সাজানো হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সদ্য প্রকাশিত বইগুলোও দ্রুত অডিও ফরম্যাটে যুক্ত হচ্ছে কাব্যিকের সংগ্রহে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশের আগেই অডিওবুক মুক্তি দিয়ে দেশে একটি নতুন ধারা তৈরি করছে প্ল্যাটফর্মটি।শুধু অ্যাপ নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম কাব্যিকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে এর শক্তিশালী ইকোসিস্টেম। ১০০ জনেরও বেশি পেশাদার বাচিক শিল্পী (ভয়েস আর্টিস্ট) কাব্যিকের জন্য নিয়মিত কাজ করছেন, যাদের অনেকেই থিয়েটার, রেডিও বা ডাবিং জগতের অভিজ্ঞ। তাঁদের আবেগপূর্ণ এবং নাটকীয় কণ্ঠে প্রতিটি গল্প যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা শ্রোতাকে কাহিনীর গভীরে নিয়ে যায়। প্রতি মাসে কাব্যিক ১০ থেকে ১৫টি নতুন অডিওবুক প্রকাশ করছে। এর ফলে একদিকে যেমন শ্রোতারা নতুন কনটেন্ট পাচ্ছেন, তেমনই বাচিক শিল্পীদের জন্য একটি নিয়মিত আয়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা এই শিল্পের টেকসই কাঠামো গঠনে সহায়তা করছে।অ্যাপটির ব্যবহারকারী-বান্ধব ফিচারগুলোও এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। অফলাইনে শোনার জন্য ডাউনলোড সুবিধা, ফোনের স্ক্রিন বন্ধ রেখেও প্লেব্যাক চালু রাখা, এবং ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় বইয়ের সুপারিশ, এই সব ফিচার শ্রোতাদের অভিজ্ঞতাকে আরও আরামদায়ক ও আনন্দময় করে তুলেছে।এরই মধ্যে কাব্যিকের গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপল অ্যাপ স্টোর মিলিয়ে মোট ডাউনলোড সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০ লাখেরও বেশি বার শ্রোতারা বিভিন্ন বই শুনেছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার সক্রিয় ব্যবহারকারী অ্যাপটিতে প্রবেশ করেন এবং মাসে একজন ব্যবহারকারীর গড় শ্রুতিকাল প্রায় ২৫ ঘণ্টা, যা প্ল্যাটফর্মটির প্রতি শ্রোতাদের গভীর আসক্তির পরিচায়ক।কাব্যিকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ তানিন ইসলাম বলেন, “আমরা শুধু বর্তমান বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আমাদের লক্ষ্য আগামী দশকে একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সাহিত্যভিত্তিক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা। এতে লেখক, ভয়েস আর্টিস্ট ও প্রকাশকরা স্থায়ী আয়ের সুযোগ পাবেন, আর শ্রোতারা পাবেন মানসম্মত কনটেন্ট।”অডিওবুক এখন আর নিছক নতুন কোনো শখ নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশনা খাতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর কাব্যিকের হাত ধরে বাংলাদেশেও সেই নবযাত্রার সূচনা হয়েছে, যা আগামী দিনে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের আরও বহু মানুষের কানে পৌঁছে দেবে।
কপিরাইট © ২০২৫ The Dhaka News Bangla । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত