রাসেদুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক ||
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মাধ্যমে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। এই নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা ইতিহাস গড়ে অধিকাংশ পদে জয়লাভ করেছেন। অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। শুধু পরাজয়ই নয়, তাদের প্রার্থীরা অনেক পদে দ্বিতীয় স্থানেও পৌঁছাতে পারেননি।দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বহীনতা এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থতা—এসবই ছাত্রদলের বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। তাদের মতে, ক্যাম্পাসে স্থায়ী উপস্থিতি না থাকা, সারা দেশে বিএনপির কিছু নেতার অরাজনৈতিক আচরণ, দুর্বল প্রচার এবং বিভক্ত নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের আস্থাহীন করে তুলেছে সংগঠনটির প্রতি। অন্যদিকে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে সচেষ্ট হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে নানা কর্মসূচি, আহতদের পাশে দাঁড়ানো এবং শিক্ষার্থীবান্ধব কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা দ্রুত আলোচনায় আসে। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও নতুনত্ব দেখিয়েছে সংগঠনটি। নিজেদের পরিচিত নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে তারা নারী শিক্ষার্থী, জুলাই আন্দোলনে আহতদের প্রতিনিধি এবং সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীকে প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করে চমক দেখিয়েছে। এই বহুমাত্রিক কৌশল দাগ কেটেছে শিক্ষার্থীদের মনে। প্রচারণায় তারা সংগঠিত ও সক্রিয় উপস্থিতি বজায় রেখেছে। প্রতিটি হল এবং বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের বার্তা। এর প্রতিফলন মিলেছে নির্বাচনের ফলে।ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও বহুল আলোচিত বিষয়। যদিও শেষ পর্যন্ত মতপার্থক্য ও গ্রুপিংয়ের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকাশ্যে সবাই প্রচারে নেমেছিলেন। তবে সেই প্রচার ছিল একেবারেই সাদামাটা; কোনো অভিনবত্ব ছিল না। শিক্ষার্থীদেরও মন ছুঁতে পারেনি। ডিজিটাল প্রচারণাতেও সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হন ছাত্রদলের প্রার্থীরা। ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিম এবং এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ কিছুটা নিজেদের তুলে ধরতে পারলেও বাকি প্রার্থীরা ছিলেন আড়ালে। এ ছাড়া পুরো প্যানেলের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা ছিল না; সবাই আলাদা প্রচারে সীমাবদ্ধ ছিলেন।এই নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রার্থীরা পরিচিত মুখ ছিলেন। আবিদুল জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আলোচিত নাম, এবং হামিম জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি গত এক বছর ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। মায়েদও আন্দোলনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন দিয়েছেন। তবে সমস্যা হলো, ২০ আগস্ট পর্যন্ত তারা জানতেন না যে, তারা ডাকসুর প্রার্থী হচ্ছেন। তাই শেষ মুহূর্তে প্রার্থী ঘোষণা হলেও নিজেদের যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি।অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বিরোধী হাওয়া বইতে শুরু করে। শিক্ষার্থীদের মনে ভর করে বসে অতীতের ‘গেস্টরুম-গণরুম’ সংস্কৃতির স্মৃতি। এই পরিস্থিতিতেই হলে হলে ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণা করা হয়, যা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেননি। বরং অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক কার্যকলাপও ডাকসুর ভোটে প্রভাব ফেলে। এমনকি কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার ‘বেফাঁস’ মন্তব্যও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলবিরোধী মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করেন অনেক শিক্ষার্থী।শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় শিবির অনেক বেশি সুসংগঠিত ছিল। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দিয়ে কমিটি গঠন করায় প্রায় প্রতিটি নেতারই ছিল সরাসরি যোগাযোগ। ক্যাম্পাসে সমস্যার সময়ে সহায়তা করা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও একাডেমিক আয়োজনেও তাদের দৃশ্যমান ভূমিকা শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখে।প্রায় এক বছর আগে থেকেই ডাকসুকে কেন্দ্র করে শিবির পরিকল্পনা সাজায়। শিক্ষা-সহায়ক কার্যক্রম, চিকিৎসা সহায়তা, রক্তদান, ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্নতা, গণঅভ্যুত্থানে আহতদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছায়। এসব সেবামূলক কার্যক্রম শুধু সমর্থকদের নয়, নিরপেক্ষ অনেক শিক্ষার্থীকেও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে।শিবির নেতাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার হাজার ‘রিজার্ভ ভোটার’ রয়েছে তাদের। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা তাদের কর্মসূচি থেকে উপকৃত হয়েছেন বা সহানুভূতিশীল ছিলেন। এসব ভোটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিবির নির্বাচনে বড় ব্যবধানের জয় পায়।প্রার্থী মনোনয়নেও নতুনত্ব দেখায় শিবির। শীর্ষ নেতৃত্বের পাশাপাশি তারা নারী শিক্ষার্থী, জুলাই আন্দোলনে আহত প্রতিনিধি এবং সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীকে প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করে। এই অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেয় যে—ডাকসু শুধু একটি সংগঠনের নয়, বরং সবার।ভিপি পদে নির্বাচিত আবু সাদিক কায়েম, জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মুহাম্মদ মহিউদ্দীন খান—তিনজনই ছাত্রশিবিরের শীর্ষ পর্যায়ের পরিচিত মুখ। কায়েম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক। ফরহাদ বর্তমান সভাপতি এবং মহিউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গণঅভ্যুত্থানে কায়েমের সক্রিয় ভূমিকা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, যা তাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। একইভাবে জুলাই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখেন ফরহাদ ও মহিউদ্দীন।প্রচারণায়ও অভিনবত্ব আনে শিবির। প্রতিটি হল ও বিভাগে সমন্বিত টিমওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। নির্বাচনী বার্তা ও কর্মসূচি স্পষ্টভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ডিজিটাল প্রচারণায়ও তারা এগিয়ে ছিলেন। কয়েকটি নির্বাচনী গান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রতিদিনের প্রচারণা কার্যক্রম ভিডিও আকারে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি অতীতের সেবামূলক কর্মসূচি ও ভবিষ্যৎ ইশতেহার নিয়েও ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন প্রকাশ করা হয়। সব মিলিয়ে এই কৌশল সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং নির্বাচনে শিবিরের বিপুল জয়ের পথ প্রশস্ত করে।
কপিরাইট © ২০২৫ The Dhaka News Bangla । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত